মোহাঃ ফরহাদ হোসেন ,কয়রা(খুলনা)ঃ ঘুর্ণিঝড় আইলা, আম্পান, ইয়াশের দুঃসহ স্মৃতি মনে করে এখনও আঁতকে ওঠেন খুলনার উপকূলীয় কয়রা উপজেলার নলপাড়া গ্রামের শতবর্ষী দুর্গাপদ মুন্ডা। দুর্যোগের সময় নদীর নোনাজলে তলিয়ে যায় তার বসতবাড়ি, শৌচাগার ও পাশের চলাচলের রাস্তা। ডুবে যাওয়া রাস্তা দিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বাধ্যহয়ে ঘরের মাচায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।
শৌচাগারের কাজ সারতে নদীর ভাটির অপেক্ষা করতে হতো তাদের। দুর্যোগে বাঁধ ভেঙে নদীর লোনাপানিতে টিউবওয়েল ডুবে যাওয়ায় নৌকায় করে দূরের উঁচু কোন টিউবওয়েল থেকে পানি আনতে হতো বলে জানান একই গ্রামের নিরাপদ মুন্ডা। তবে দুর্যোগের সময় কয়রার মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে বেসরকারি সংস্থা জাগ্রত যুব সংঘ (জেজেএস) কয়রা সদর, উত্তর বেদকাশী ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নে প্রায় ১০ কিলোমিটার রাস্তা, ১২৫টি গভীর নলকূপ স্থাপন, ২৭টি উঁচু টয়লেট নির্মাণ এবং ১৪টি সাইক্লোন শেল্টারে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ট্যাংক স্থাপন করেছে। এতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে কিছুটা হলেও দুর্যোগের নোনাজলের ক্ষত কাটিয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখছেন কয়রার মানুষেরা।
উপজেলার নলপাড়া গ্রামের বাসিন্দারা জানান, বেসরকারি সংস্থা জেজেএস’র পক্ষ থেকে যেভাবে উঁচু করে রাস্তা, টিউবওয়েল ও শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছে তাতে কোন দুর্যোগ হলে অন্তত্ব সেখানকার বাসিন্দাদের টয়লেটের জন্য কষ্ট করে ভাটির অপেক্ষা করতে হবে না। কয়রা সদর ইউনিয়নের ৫নং ওর্য়াডের ইউপি সদস্য শেখ সোহরাব হোসেন বললেন, দীর্ঘ ১ যুগে যা করা সম্ভব হয়নি, সেটি ওই বেসরকারি সংস্থা মাত্র দু’বছরে সম্পন্ন করে দেখিয়েছে। এভাবে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলো এগিয়ে আসলে দুর্যোগপ্রবণ উপকূলীয় কয়রার বাসিন্দারা যে কোন ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারবেন বলেও আশা তাদের। ৩ নং কয়রা গ্রামের বাসিন্দা রবিউল ইসলাম বলেন, আমাদের বাড়ির পাশের রাস্তাটি আাগে অনেক নিচু ছিল।
দুর্যোগের সময় বাড়িতে পানি উঠে যাওয়ায় আগে রাস্তাটি ডুবে যেতো। পরিবারের সদস্যদের সাথে সাথে গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পরতে হতো। এখন পাশের রাস্তাটি উঁচু করায় দুর্যোগের সময় অন্তত্ব রাস্তার ওপরও থাকা যাবে। গবাদি পশুগুলোও রাখা যাবে। কয়রা মদিনাবাদ দাখিল মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত সুপারিনটেনডেন্ট শাহাদাত হোসেন বলেন, তার মাদ্রাসায় উচু টয়লেট স্থাপন, উঁচু করে নলকূপের স্থাপন ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে জাগ্রত যুব সংঘ। এতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দারাও উপকৃত হচ্ছে। ঘুর্ণিঝড় আইলায় কয়রার উত্তর বেদকাশী ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন প্রায় সাড়ে তিন বছর নদীর লোনা পানিতে প্লাবিত ছিল।
সেখানকার বাসিন্দারা জানান, প্লাবনের সময় রাস্তার উপর ঝুপড়ি ঘর তুলে বসবাস করতে হতো তাদের। তখন টয়লেটগুলো তলিয়ে যায়। খোলা জায়গায় টয়লেট করতে বাধ্য হতো মানুষ। মহিলাদের শৌচাগারের কাজ সারতে রাতের জন্য অপেক্ষা করতে হতো। এখন টয়লেট উঁচু করায় যে কোন দুর্যোগে তাদের সে সমস্যায় পড়তে হবেনা। রাস্তা নির্মাণ, টয়লেট উঁচুকরণ, সুপেয় পানির জন্য টিউবওয়েল স্থাপন এমনকি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ সম্পর্কে উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সরদার নুরুল ইসলাম কোম্পানী বলেন, সবগুলো কাজের মান নিয়ে আমরা খুবই সন্তুষ্ট।
রাস্তার স্থায়িত্বের জন্য দু’পাশে গাছও লাগানো হয়েছে। এখন এর ওপর ইটের সলিং দেয়া হলে রাস্তাগুলো আরও টেকসই হবে। তিনি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে আরও কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করার আহবান জানান জেজেএস’র প্রতি। জাগ্রত যুব সংঘের নির্বাহী পরিচালক এটিএম জাকির হোসেন বলেন, আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় দেখেছি নারী ও শিশুদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়তে হয়। বিশেষ করে টয়লেট ব্যবস্থা নিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা রয়েছে কয়রার মানুষের।
আবার রাস্তা না থাকায় দুর্যোগের সময় অনেকে ইচ্ছা থাকলেও আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারেন না। এসব কারণে আমরা কিছু রাস্তা, টয়লেট ও টিউবওয়েল উঁচু করেছি। জেএেসের সমন্বয়ক আব্দুল মালেক বলেন, আমরা কয়রা সদর, উত্তর বেদকাশী ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নে প্রায় ১০ কিলোমিটার রাস্তা সংস্কার করেছি। এ জন্য ব্যয় হয়েছে এক কোটি ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৮৮২ টাকা।
এছাড়া তিন ইউনিয়নে ১২৫টি টিউবওয়েল, ২৭টি উঁচু টয়লেট ও ১৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য ট্যাংকি ও বেসিন স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও প্রায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার রাস্তার পাশে চার হাজার ৫১ টি নিম, মেহগনী ও সিরিস গাছ লাগানো হয়েছে।
Leave a Reply